আলবার্ট আইনস্টাইন: অনেকে বলে থাকেন, তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। আবার অনেকে বলে থাকেন, তিনি না থাকলে আমরা নাগাসাকি হিরোসীমার ওই ভয়ঙ্কর ছবি দেখতাম না। তাঁকে ঘিরে তর্ক-বিতর্কের ঝড় ওঠে। কিছুদিন আগে তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শতবার্ষিকী পালিত হয়। তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তিনি হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন।
আইনস্টাইনের সবচেয়ে বড়ো পরিচয় এত বড়ো বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন মনে প্রাণে সাধারণ মানুষ। জীবনে সফলতার চূড়ায় উঠেছিলেন। রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে দেশ ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। এমনকি মাঝে মধ্যে প্রাণনাশের চিঠিও হাতে পেতেন তিনি। তবুও অবিচল ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। বিশ্বাস করতেন মানুষের মানবতাকে। যুদ্ধ নয়, শাস্তি চাই এনন কথাই বলে গেছেন জীবনের শেষ চেতন–প্রহর পর্যস্ত। অথচ, ভাবতে খারাপ লাগে, পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
একনজরে আলবার্ট আইনস্টাইন
নাম (Name) | আলবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein) |
জন্ম (Birthday) | 14 মার্চ 1879 (14th March 1879) |
জন্মস্থান (Birthplace) | উল্ম, জার্মানি |
অভিভাবক (Perents)/ পিতা ও মাতা | হিমার আইনস্টাইন (পিতা)পলিন কোচ (মাতা) |
দাম্পত্য সঙ্গী (Spouse) | মিলেভা মেরিক (1903 সালে), এলসা লভেন্থাল (1999 সালে |
নাগরিকত্ব | জার্মান, সুইজারল্যান্ডীয়, অস্ট্রিয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
উপাধি | নোবেল বিজয়ী |
সন্মান | কোপলি পদক, ম্যাক্স প্যালাঙ্ক মেডেল, গ্রেট প্রাইজের শতবর্ষ (1999) |
কর্মক্ষেত্র | পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন |
মৃত্যু | 18 এপ্রিল 19955 (18th April 1955) |
আইনস্টাইনের জন্ম
1879 খ্রিস্টাব্দের 14 মার্চ ব্যাভিরিয়ার উপম প্রদেশে আলবার্টের জন্ম হয়েছে। একবছর বয়সে তাঁর পরিবার চলে আসে সুন্দর সাজানো শহর মিউনিখে। মিউনিখে এসে একটু থিতু হয়ে বসেছিল আইনস্টাইনের পরিবার। মিউনিখের এক সুন্দর বাড়িতে আলবার্টের সোনালী শৈশব অতিবাহিত হয়। আলবার্টের বয়েস যখন মাত্র দুবছর, তখন বোন মাজার জন্ম হয়। আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন ঘরকুনো স্বভাবের। বাড়ির সকলকে একসঙ্গে পেলে আর কিছু চাইতেন না।
আইনস্টাইনের শৈশবকাল
মা, বাবা, কাকা আর বোন মাজাকে নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার। আলবার্টের মা পলিন গান গাইতে ভালোবাসতেন। বেহালাও বাজাতেন তিনি। মার কাছ থেকে বেহালার বাজনা আয়ত্ত করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। যখন তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, তখনও সময় ও সুযোগ পেলে একা একা বেহালা বাজাতেন। বেহালার মধ্যেই জীবনের আসল নির্যাস লুকিয়ে আছে—এমন কথা বিশ্বাস করতেন আলবার্ট। রোজ সন্ধ্যায় বাড়িতে সাংস্কৃতিক আসর বসত। বাবা এবং কাকার বন্ধু-বান্ধবরা আসতেন। কবিতা পাঠ হত, রাজনৈতিক আলোচনা—আরও কত কী? তখন আলবার্টের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। কিছুদিনের জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতা কেটে গেল। আলবার্টের হাতে নিত্য নতুন খেলনা এল। একদিন বাবা তাঁকে একটি নৌ-কম্পাস দিয়েছিলেন। এটি পেয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন ভারি – খুশি। শুধু খুশি হওয়া নয়, কীভাবে এই নৌ-কম্পাসটি কাজ করছে, তা জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। কম্পাসের কাঁটা নড়া তাঁকে অবাক করে দিয়েছিল। ছোটো থেকে আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন অনুসন্ধিৎসু মনের। অসংখ্য প্রশ্ন করে। মা-বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন। আকাশ থেকে পৃথিবী, মরুভূমি থেকে মরুদ্যান, সবুজ ঘাস থেকে উড়ন্ত প্রজাপতি—সবই ছিল আলবার্টের প্রশ্নের বিষয় বস্তু।
আইনস্টাইনের শিক্ষাজীবন
আলবার্ট আইনস্টাইন ভর্তি হয়েছিলেন রোমান ক্যাথলিক-এর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন স্কুলে ধর্মকে একটা আবশ্যক বিষয় হিসেবে পড়ানো হত। বিভিন্ন পরিবারের ছেলেরা এই স্কুলে পড়তে আসত। তবে বেশির ভাগ ছিল ক্যাথলিক ধর্মের ছাত্র। আলবার্ট আইনস্টাইন অবাক হয়ে লক্ষ করতেন, বড়োলোকদের দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন। যারা গরিব এবং মধ্যবিত্ত তাদের স্কুলের শেষের বেঞ্চে বসতে বলা হচ্ছে। এই সামাজিক বিভাজন সেদিনের কিশোর আলবার্টকে যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছিল। ধীরে ধীরে আলবার্টের বাবার আর্থিক অবস্থা খুব উন্নত হয়ে উঠল। ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। ধর্মের ব্যাপারে আলবার্টের পরিবার ছিল অত্যন্ত উদার।
তাঁরা ছিলেন ইহুদি, কিন্তু বাড়িতে ধর্ম নিয়ে বেশি আলোচনা হত না। ন-বছর বয়েস তখন আলবার্টের, একটি কথা মনে পড়ে তাঁর। একদিন শিক্ষক ঢুকলেন একটি পেরেক হাতে। সেটি দেখিয়ে খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়া যন্ত্রণার কথা বলেছিলেন। কিশোর আলবার্ট এই গল্প শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সমস্ত রাত ঘুমোতে পারেন নি।
দশ বছর বয়সে ভর্তি হলেন মিউনিখের লিউটপোল জিমনাসিয়াম স্কুলে। ইতিমধ্যে পড়াশোনাতে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছেন তিনি। অন্য ছেলেরা যখন অঙ্ক দেখলে ভয় পায়, আলবার্ট তখন মনের সুখে অঙ্ক করেন। অঙ্ক ছিল তাঁর সবথেকে প্রিয় বিষয়। মুখে মুখে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতেন।
অঙ্ক শেখার জন্য ম্যাকস টলেমি নামে এক ভদ্রলোকের সাহায্য পেয়েছিলেন। টলেমি তখন ডাক্তারি পড়ছেন। আলবার্টকে খুবই ভালোবাসতেন। লিউটপোল জিমনাসিয়ামে অঙ্কের পাশাপাশি গিক এবং লাতিন ভাষা শিখতে হত। এ দুটি বিষয় আলবার্টের পছন্দ ছিল না।
শেষ পর্যন্ত এক মাস্টারমশাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন। তিনি বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের নাম আলবার্টকে শুনিয়ে ছিলেন। মাঝে মধ্যেই সেইসব সাহিত্যিকদের লেখা নির্বাচিত অংশ পাঠ করে শোনাতেন। তখন থেকেই নিশ্বসাহিত্যের প্রতি। আলবার্টের অনুপ্রেরণা জন্মাতে থাকে। মিউনিখ শহরের পরিবেশ একেবারে পালটে গেছে। সব সময় সৈন্যদের কুচকাওয়াজ চোখে পড়ছে। অনেককে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হচ্ছে। আলবার্টের কাছেও এই প্রস্তাব করা হল। ভাগ্যিস আলবার্ট সেদিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি, তাহলে জীবনটা তাঁর একেবারে ভিন্ন পথে পরিচালিত হত।
চারটি বছর কেটে গেল অসহা যন্ত্রণাকে বুকে চেপে ধরে। গোটা বাভেরিয়া প্রদেশের অবস্থা তখন সংকটজনক। বাভেরিয়া সংযুক্ত জার্মান সংঘে যোগ দিয়েছে। ফ্রান্স এবং জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ বেঁধেছে। জীবনের সৃজনমূলক মুহূর্তগুলি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। শেষ অব্দি মা-বাবা চিন্তা করলেন, আর মিউনিখ শহরে থাকা সম্ভব হবে না, অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। ওঁরা এলেন মিলানে। আলবার্ট কিছুদিন বাদে মিলানে এলেন। এখানে এসে ডিপ্লোমা পেলেন না। কারণ জিমনাসিয়ামের প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ করতে পারেননি।
মিলান শহরটি তাঁর খুবই ভালো লাগত। উত্তর ইতালির এই শহরের উত্তরে আল্পস পর্বতমালা। মিলান এক পুরোনো শহর। অনেক দিনের ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে আছে। আলবার্ট চাইছিলেন জার্মান দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশুনা করতে। কথায় কথায় সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের সুইস ফেডারেশন পলিটেকনিক স্কুলটির নাম শুনলেন। এই স্কুলে ঢোকা খুব একটা সহজ নয়। ডিপ্লোমা শেষ না করে চলে এসেছিলেন, তাই আলবার্টকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। প্রথমবার সফল হলেন না। কিন্তু অঙ্কে তাঁর দক্ষতা দেখে সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
আবার নতুন করে প্রয়াস শুরু হল। পড়াশোনা করলেন আরাউ স্কুলে। এখানকার পরিবেশ আলবার্টের খুবই ভালো লেগেছিল। দশ মাস আরাউ স্কুলে পড়াশোনা করে এলেন ফেডারেশন পলিটেকনিকে। আরাউ ছেড়ে চলে আসার সময় আলবার্টের মন বিষাদ ক্লিষ্ট হয়ে যায়। যেখানে থাকতেন সেই উনটিলারের পরিবারের সকলকে তিনি নিজের মতো করে ভালো বেসেছিলেন। আরাউ-এর পরিবেশটা ছিল সত্যিই খুবই সুন্দর। শান্ত-স্নিগ্ধ গ্রামীণ পরিমণ্ডল। পাশ দিয়ে তিরতির করে ছুটে চলেছে একটি ছোট্ট নদী।
জুরিখের পরিবেশটাও অবশ্য ভালো লাগে আলবার্টের। সেখানে গিয়ে হাঙ্গারির মেয়ে মিলেভা মারিসের সঙ্গে সখ্যতার সম্পর্ক হল। দুজনে মনের সুখে অঙ্ক করতেন। পেয়েছিলেন আর এক বন্ধুকে। তাঁর নাম ফ্রেডরিক আডলার। তিনি এসেছিলেন অস্ট্রিয়া থেকে। জুরিখের বিদ্যালয়ে চার বছর আলবার্ট পড়াশোনা করেন। এই সময়সীমাটিকে তিনি তাঁর শৈশবের সেরা সময় বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে তখন অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। অনেক সময় কিছু না খেয়ে কাজ করতে হত। জুরিখের স্কুলে পড়াশোনা শেষ হল। আলবার্ট ভাবলেন সুইজারল্যান্ডে চলে যাবেন। না, এবার তাঁকে চাকরি করতেই হবে। না হলে সংসারের হাল ধরবেন কী করে?
আলবার্ট আইনস্টাইনের কর্মজীবন
আলবার্ট এলেন কর্মজগতে। জুরিখের পলিটেকনিকে স্কুলে যোগ দেবার জন্য আবেদন করলেন। তিনি ধর্মে ইহুদি, তাই তাঁর আবেদন প্রত্যাখান করা হল। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে সেদিনের সদ্য তরুণ আলবার্ট খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। মানুষকে কেন ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হবে—ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বারবার এই প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু কে দেবে সঠিক জবাব?শেষ অব্দি সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরের পেটেন্ট অফিসে কেরানীর চাকরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ভবিষ্যতের বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। এরই পাশাপাশি চলেছে গবেষণার কাজ। ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন স্কুলের বন্ধু মিলেভাকে।
শুরু হল আলবার্টের নতুন জীবন। ১৯০৫ সালে আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সর্বত্র তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তারপর? আলবার্টকে জার্মান দেশ ছাড়তে হল। আমেরিকাতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হল। গ্রহণ করতে হল সেদেশের নাগরিকত্ব। পেলেন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার।
তোমরা শুনলে অবাক হয়ে যাবে যে, ১৯১০–১৯২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর নাম আট-আটবার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনস্টাইনের সাথে এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে আছে। তিনি হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে জাপানের বুকে পরমাণু বোমা বিস্ফোরিত হয়।
পরমাণু বােমা সেম্পর্কে আইনস্টাইনের গবেষণা উল্লেখ করার মতো। কিত্তু আলবার্ট আইনস্টাইন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, তাঁর আবিদ্ধার একদিন মানুষের জীবনদীপ নিভিয়ে দেবে। মৃত্যুযর আগে পর্যন্ত তিনি ওই ঘটনার জন্য অনুতপ্ত ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল আলবার্ট আইনস্টাইন দূর আকাশের তারা হয়ে যান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু আস্ন। চারপাশে যেন অন্ত্যেষ্টি কাজকর্ম না হয়। এমনকি তাকে ঘিরে কোনো স্মৃতিসৌধ বা সমাধি মন্দির যেন তৈরি না হয়।
এই হলেন মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। আমরা তাকে বলে থাকি বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে সবথেকে বিস্ময়কর চরিত্র।